ছলনার আশ্রয়
– শচীদুলাল পাল
ব্যাঙ্গালোরের যশবন্তপুর থেকে হাওড়া গামী দুরন্ত এক্সপ্রেসের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরা। এক মহিলার সাথে আকস্মিক দেখা। মহিলার লোয়ার ও আমার মিডল বার্থের সিট।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। অবশেষে আমি মেয়েটির চিবুকে তিল, কোঁকড়ানো চুল, টিকলো নাক, পটলচেরা চোখ, পানপাতার মতো মুখ দেখে চিনতে পেরে সাহসে ভর করে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনি কি শেফালী? হিন্দুস্তান কেবলসের কো এডুকেশন স্কুলে আমার ক্লাস মেট ছিলেন?
মেয়েটি স্মিত হাস্যে বললো, যদি বলি- হ্যাঁ।
– কতদিন বাদে দেখা। সেই যে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে কে কোথায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আপনি এখন কোথায় থাকেন। কোথায় গিয়েছিলেন। কেমন আছেন?
-এতদিন বাদে যদি দেখা হলো তাহলে আবার ‘আপনি’ কেন? পুরানো বন্ধু, ক্লাস মেট। তুই বললেই খুশি হবো।
একই দিকে লোয়ার ও মিডল বার্থ থাকায় দুজনে একসাথে খাবার খাওয়া, ঘুমানো
গালগল্প করে কাটতে লাগলো।
– এইচ এস পাশ করে বি. এস. সি-তে (ম্যাথেমেটিক্স) এডমিশন নিয়েছিলাম। পাশ করার সাথে সাথে বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন উত্তর কলকাতায়। বিশাল বাড়ী। একান্নবর্তী পরিবার। স্বামী সরকারি অফিসার। একছেলে এক মেয়ে। ছেলে আমেরিকায়। মেয়ে জামাই ব্যাঙ্গালোরে সার্ভিস করে। এখন সেখান থেকেই আসছি। তোর কি খবর?
– আমারও এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে এই ব্যাঙ্গালোরে থাকে। মেয়ে জামাই কলকাতায় চাকরি করে। জামাই সরকারি ডাক্তার। আমার আর কিছু বলার নেই। সবাই বেশ আছি।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি, তুই স্কুলে খুব বকবক করতিস। বকবকানির জন্য কতবার ক্লাসে শাস্তি পেতে হয়েছে তোকে। মনে আছে? এখন তো কিছু বল, যা শুনতে শুনতে পথ চলি এই দুরন্তের কামরায়।
-ঠিক আছে। এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প বলে শোনাচ্ছি। মন দিয়ে শোন।
স্বামী গত হবার পর শরিকরা জমি জমা বেচে দিল। সবাই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমিও যা টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে সল্ট লেকে একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকি। আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবরা কেউ কারো খোঁজ নেয় না।
এখানেও তাই। কেউ কারো খোঁজ নেয় না।অধিকাংশ ফ্ল্যাট তালামারা। দুরদেশে বা বিদেশে থাকে। বড়োই নিরালা। একাকীত্ব। অনেক সময় কাজের মেয়েও পাওয়া যায়না।
কোমর ব্যথা, অস্টিওপরোসিস, আর্থাটাইটিস ইত্যাদিতে ভুগছি।
শেফালী তার জীবন কাহিনী বলতে লাগলো।
দুরন্ত গতিতে দুরন্ত এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে। তার থেকেও দ্রুতগামী মন ছুটে চলেছে শেফালীর গল্পের বর্ণনা।
-স্বামীর মূত্যুর সর পুত্র কন্যারা দূরে থাকলেও আমি সুখীই ছিলাম। খুব ভালো ছিল। সুন্দর স্বভাবের ছিল আমার পরিবারের সবাই। তারা নিয়মিত খোঁজ নেয়। ভিডিও চ্যাট করে। সুখ আর আনন্দের সীমা ছিল না।
ছেলে মেয়ে মাঝে মাঝে যখন সময় পায় মা’কে এসে দেখে যায়। যখন আসে নাতি নাতনি ছেলে বউমা, মেয়ে জামাইয়ে ভরপুর সংসার। কি আনন্দ। ভরপুর জমজমাট।
সুপ্রিয়া নামে আমার এক বান্ধবীকে এক ভালো বিশ্বস্ত কাজের মেয়ের জন্যে ফোন করেছিলাম।
একদিন সকালবেলা বাইরে কলিং বেলের আওয়াজ।
দরজা খুলে দেখি এক মাঝবয়সী মহিলা। কপালে সিঁদুর। পরনে তাঁতের শাড়ি। সস্তার ভ্যানিটি ব্যাগ। কিছু বেচতে এসেছে! নাকি সাহায্যপ্রার্থী!
বেজার গলায় জিজ্ঞেস করলাম- কি চাই?
হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললো- আমি আরতি। আপনার বান্ধবী সুপ্রিয়া ম্যাডাম আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি একজন কাজের মেয়ে খুঁজছেন?
– কে কাজ করবে?
– আমি করবো।
– আপনি পারবেন? দেখে তো ভদ্রমহিলা মনে হচ্ছে।
– না পারার কি আছে..
– কি কি কাজ করতে পারেন?
– আপনি যা চেয়েছেন সবই পারি। দেখুন না রেখে। পছন্দ হলে রাখবেন। না হলে রাখবেন না। সুপ্রিয়া ম্যডাম আমায় সব বলে দিয়েছেন, কি কি করতে হবে।
– ঘরে আসুন।
সোফা চেয়ারে না বসে আরতি এক ছোট্ট টুলে বসে পড়লো।
– বলুন কি কি কাজ করবেন?
– আমাকে আপনি বলবেন না। তুমি বললেই চলবে। আমি আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো। আমি ঝাড়ু দেওয়া, ঘর মোছা, রান্নাবান্না ছাড়া ম্যাসাজ করতে পারি।
– ম্যাসাজ? কতদিন ধরে করছেন এই ম্যাসাজের কাজ?
-দেখুন আমি হাসপাতালে আয়ার কাজ করতাম। নাইট ডিউটি থাকাকালীন এক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে অনেক কিছুর বিনিময়ে এ কাজ আমি শিখেছি। তিনি আমার গুরু। তিনি না থাকলে এই ভদ্রভাবে জীবন কাটাতে পারতাম না।
ব্যাগ খুলে কতগুলি চিঠি অর্থাৎ প্রসংশাপত্র আমার হাতে দিয়ে বললো- পড়ুন এইসব।
– আমি পড়ে থ। এত অনেক বিশিষ্ট মহিলার লেখা প্রসংশাপত্র!
বললাম – তা আজ থেকেই কাজ শুরু করো।
আমার সাথে শোবার ঘরে এলো আরতি।
– পাউডার দিয়ে নাকি তেল দিয়ে করবো?
আমি বললাম, তেল দিয়েই করো।
একটা শ্রী প্রডাক্টের তেলের শিশি ছিল সেটাই দিলাম।
-আরতি আমাকে শুতে বলে তেল চিটচিটে একটা সিন্থেটিকের শাড়ি বার করলো। শুরু করলো কাজ।
নাহ, মহিলাটি মালিশটা ভালোই জানে।অনর্থক চাপ দিচ্ছে না। দলাইমলাই করছে না। স্নায়ু বুঝে শিরা ধরে চমৎকার টান দিচ্ছে। নিপুণ অঙ্গুলি চালনার কৌশলে ঘন্টা খানেকের মধ্যে ঝরঝরে হয়ে গেল শরীর।
ঠিক করে ফেললাম এরকম এক ফাইভ ইন ওয়ান মহিলা পাওয়া বিরল বললাম, পারিশ্রমিক কত? কতক্ষণ থাকবে?
– দেখুন ম্যাডাম আমি সকাল ছটায় আসব আর দুটোতেই চলে যাব। এজন্য আমাকে আপনি মাসে ৫ হাজার টাকা দেবেন।
ভেবে দেখলাম একে কোনো মতেই হাতছাড়া করা যায় না। বলে দিলাম। তুমি রোজ আসবে। পাঁচহাজার নয় তোমাকে আমি ছয় হাজার দেব।
– ঠিক আছে। তা আমাকে কিন্তু দুটোতে ছেড়ে দিতে হবে।
– ঠিক আছে।
-ঠিক আছে, আমি রাজি। সব কাজ ছেড়ে আমি আসব। একজনের রান্না। থালা বাসন মাজা। ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ঘর পোছা। কাপড় কাচা। ম্যাসাজ মালিশ করা এই তো কাজ। আমি রাজি।
– তোমার আজ থেকেই চাকরি পাকা।
মাসখানেকের মধ্যে ফল পেলাম মালিশের। কোমরের ব্যথা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। দিব্যি ঝরঝরে লাগে। বেশ কয়েকটি ফ্রি হ্যান্ড শিখিয়েছে। মেদও ঝরেছে অনেকটা। যতক্ষণ থাকে সব সময় বকবক করে।
ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ বেশ নিষ্ঠার সাথে করে। তাকে পেয়ে আমি খুব খুশি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ঘরে আর কে কে আছেন?
– আমার দুই ছেলে তপন, রতন আর স্বামীকে নিয়ে থাকি। স্বামী বাদল একটা ব্যবসা করতো। চানাচুর তৈরি। অনেকে দোকান থেকে নিয়ে যেত। ব্যাবসা ফুলে ফেঁপে উঠলো। কত মহাজন মালের জন্য হাঁ পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকতো দোড়গড়ায়।আমার গায়ে তখন গয়না উঠেছে। দামি দামি শাড়ি হয়েছে।
– তারপর?
– সবই কপাল, যে মহাজনদের পেট পালার ব্যবস্থা করে দিল, তারাই আমার স্বামীকে ঠকাতে শুরু করে দিল। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিল এক কর্মচারী। যাকে বিশ্বাস করেছিল আমার স্বামী সেই কর্মচারী একদিন পেটি পেটি মাল চুরি করে হাওয়া। মনের দুঃখে স্বামী ছ’ মাস বিছানায় শয্যাশায়ী। আমি আর কি করি। ঘরে কচি কচি দুই ছেলে। তাদের মুখে অন্ন জোটাতে হবে তো তাই এক হাসপাতালে আয়ার চাকরি নিলাম। আয়ার চাকরি বুঝতেই পারছেন। তপনের বাবা তো কান্নাকাটি জুড়ে দিত। তোমাকে ও কাজ করতে হবেনা। তুমি বাদল দুবের বউ। ব্রাহ্মণের বউ। এ মেনে নিতে পারছিনা।
তপনের বাপ দমবার পাত্র নয়। একটু সুস্থ হতেই সে একটা চপ, সিঙাড়া, কচুরির সাথে চায়ের দোকান দিল। পাশের এক দোকানদারের হিংসা হলো। কারণ তার দোকানের খদ্দেররা সব আমার স্বামীর দোকানে আসতে শুরু করলো। দোকান একদম রমরমা চলতে লাগলো। ছেলে দুটিকে ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। তারা ভদ্র পরিবেশে বড়ো হতে লাগলো।
-তারপর…
-একদিন পাশের দোকানদার একদল লোককে মদ খাইয়ে পাঠিয়ে দিল। তারা হুজ্জুতি করলো। দোকান ভাঙচুর করে দিল। আবার আমরা পথে বসলাম। বড়ো ছেলে তপন ট্যাক্সি চালায়। সে বললঝ, তোমাকে আর কাজকর্ম করতে দেব না। আমি সংসার দেখব। ছোট ছেলে এক বড় পুরোহিতের কাছ থেকে পুরোহিত বিদ্যা শিখে পুজাপাঠ করে ভদ্রভাবে অনেক টাকা রোজগার করে। দুই ছেলেই বললো, তোমাকে আর কষ্ট করে কাজ করতে হবে না মা।
কিন্তু আমি বললাম, আমি যে বিদ্যা জানি সে বিদ্যা দিয়ে রোজগার চালিয়ে অতিরিক্ত আয় হবে। তোদের সংসারে বাড়তি আয় হবে। আরও সচ্ছল হবে।
ইতিমধ্যে তপনের বাবা লুচি পরোটার আর একটা দোকান বসালো মোড়ের মাথায়। এখন সেটা চলছে।
গতবছর পুজোর পর আরতিকে বলে মেয়ের ডাকে ব্যাঙ্গালোরে গেলাম দু৬ সপ্তাহের জন্য। তার বেতন এডভান্স দিয়ে দিয়েছিলাম।
তারপর ফিরে গিয়ে দেখি আরতির আর পাত্তা নেই। দিন গেলো, সপ্তাহ গেল, মাস গেল। আরতি আর আসে না।
একদিন বান্ধবী সুপ্রিয়াকে ফোন করলাম।
– কি রে, কেমন আছিস সব।
– আমরা ভালো আছি। তোর কি খবর বল?
– ভালোই, তবে তোর ঐ আরতির পাত্তা নেই। অনেকদিন থেকেই আসছে না। খুব ভালো মেয়ে। এখন আরতিকে না পেয়ে মন খারাপ। সংসারের যাবতীয় কাজ করতো। শুধু দিনরাত বকবক করতো। সেগুলি বেশ ভালো লাগতো শুনতে। একটু খোঁজ নিয়ে দেখ। নাহলে ঠিকানাটা বল।
– আমি ঠিকানা জানি না। তবে তোর আবাসনের পাশে যে বস্তিটা আছে ওখানেই ওর বাড়ি।
– ঠিক আছে।
একদিন বেরিয়ে পড়লাম একটি টোটো রিজার্ভ করে। যে করে হোক খুঁজে বার করবোই।
বস্তিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে প্রথমত কেউ বলতে পারলো না। আরতি নামে এক মেয়ে মালিশ করে বলতেই অনেকে দূর থেকে বাড়িটি দেখিয়ে দিল।
বস্তিতে গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। শুধু চারিদিকে ঝগড়াঝাটির আওয়াজ। অশ্লীলতম ভাষার গালিগালাজ। অশ্লীল গালিগালাজ শুনতে লোক জড়ো হয়েছে। বিশেষত মেয়েরা খুব মজা নিচ্ছে। বাচ্চারা চেঁচিয়ে যাচ্ছে।। যে মেয়েটি অশ্লীল গালিগালাজ করছিল সে সামনে আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো।
আমি বললাম, আমি আরতির খোঁজে এসেছি।
-আরতি মানে, মালিশ দিদি!
-হ্যাঁ।
-সে তো হাসপাতালে।
-কেন। তার কি হয়েছে?
-তার কিছু হয়নি। তার মরদের লিভার পচে গেছে।
-আহা!
– আহা করার কিছু নেই। চুল্লু খেয়ে লিভারটি গেছে। সারাজীবন কিছুই করেনি। শুধু আরতিদিদির রোজগারে থাবা বসিয়েছে। মদের টাকা না দিলে দিনরাত মার। আমরা না থাকলে আরতিদিকে মেরেই দিতো।
– তবে যে আরতি তার স্বামীর প্রসংশা করতো। বলতো, সে অনেক ভালো।
অনেক কষ্টে ব্যাবসা করে সংসারটাকে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীরা চলতে দেয়নি।
-সব মিথ্যা কথা। বাদল একটা চানাচুর তৈরির কারখানায় কাজ করতঝ। সেখানেও চুরির দায়ে তার চাকরি চলে যায়। বাদল চুরি করতো আর মদ খেয়ে টাকা ওড়াত।
– তারপর বাদলটা এক তেলেভাজা দোকানে চাকরি পেয়েছিল। সেখানে মদ খেয়ে হুজ্জুতি করে ভাঙচুর চালায়। কোথাও কিছুই করতে পারেনি।
-কেন সে নাকি মোড়ে লুচি পরোটার দোকান দিয়েছিল!
-সেটাও মিথ্যা কথা। আরতিদি ঘুঘনি তৈরি করে দিত। সেই ঘুঘনি বেচতো। যা টাকা বিক্রি করে আসতো তা দিয়ে চুল্লু কিনে খেত।
আরতিদির জন্য সংসারটা টিকে আছে। আর সেই আরতির উপরই দিনরাত চড়াও হতো সবাই মিলে। মেরে মর্দানি দেখাতো।
-ছেলে দু’টি তো শুনেছি ভালো ছিল।
– কি উল্টো পালটা বলছেন। একজন তো মাকে ছেড়ে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। আরেকটা তো একদম বখাটে। মদ খায়। গাঁজা খায়। টাকার দরকার পড়লে মায়ের টাকা চুরি করে। তার প্রেম করে বিয়ে করা বউটা তো শাশুড়ীকে মারত। খেতে দিত না। খাবারের থালা উঠিয়ে নিয়ে চলে যেত।
ছোটটা এক নম্বর পাজির পা-ঝাড়া। টাকা না দিলে মায়ের হাত দুমড়ে মুচড়ে দিতো। মাকে মারত।
এই বস্তিতে ভালো কেউ নাই। তার মধ্যে বাদল আর তার ছেলে বউমারা একদম ছোটলোক চুয়াড়।
বস্তির বউটার কথা সব শুনে আমি এক্কেবারে থ হয়ে গেলাম।
তাড়াতাড়ি টোটোতে করে ভাবতে ভাবতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম।
কী নিপুণ অভিনয় করতে পারে আরতি।কেমন সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলে যেত আরতি দিনের পর দিন। দৈন্য ঢাকতে চায়?
লুকিয়ে রাখতে চায় নিজের অসহায়তা? সত্যি বললে তো বরং মায়া বাড়ে মানুষের। আশ্চর্য মহিলা তো?
প্রায় মাস দুয়েক পর আরতি এলো। এসে সে সেই ছোট টুলতাতেই বসলো। আগের চেয়ে
অনেকটা রোগা হয়েছে। সিঁথিতে সিঁদুরটা নেই। একটা সাদা শাড়ি পড়েছে। টুলে বসে আরতি আগের মতো বকবকানি শুরু করে দিলো।
-এবার পুজার পর তপনের বাপ বললো, চলো কোথাও তীর্থে ঘুরে আসি। সেই মতো ঠিক হলো বারাণসী যাব। কাশীতে বিশ্বনাথ দর্শন করে প্রয়াগে যাব। ছেলে দুটিও তীর্থ করার জন্য টাকা দিল। বউমা ট্রেনে বসে টুকটাক খাওয়ার জন্য শুকনো খাবার তৈরি করে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে দিলো। হাওয়া ভরা বালিশ কিনে দিল। বেশ আরামে পৌঁছালাম। বিশ্বনাথ দর্শন করে গেলাম প্রয়াগে। গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর সঙ্গমে অর্থাৎ ত্রিবেণীতে স্নান করলাম। ফিরেও এলাম কাশীতে।
যেদিন ফিরব সেদিন হঠাৎ তপনের বাবার বুকে ব্যথা। কয়েকঘন্টা মাত্র সময়। সেইসময়ের মধ্যে কিছু বুঝে উঠতে পারার আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। সবাই বললো, অনেক পুণ্যিবান। মহাতীর্থে মৃত্যু। মণিকর্নিকার ঘাটে শেষকাজ করলাম।
আমি অবাক বিস্ময়ে আরতির মিথ্যা কথাগুলি শুনলাম। তার কথা বলার ভঙ্গিতে আমি মুগ্ধ হলাম। কি অদ্ভুত মহিলা।
আমার আর স্বর ফুটছিল না। মিথ্যে নয়। তার যে সুপ্ত বাসনাগুলো ছিল। তার স্বামী পুত্র সংসার কেমন হতো। যে স্বপ্ন সে দিনরাত দেখতো সেগুলো তার মিথ্যের মালা হয়ে বেরিয়ে আসতো। সে যেটা চেয়েছিল তাই তার মুখ দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে গল্প করে বানিয়ে বলতো।
দুরন্ত এক্সপ্রেসে আমরা হাওড়া এসে পৌছে গেলাম। শেফালি তার সল্টলেকের ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিয়ে বলল দেখা করতে।
কথা দিলাম যাব।
আমার গল্পটা এইখানে শেষ হয়ে যেত কিন্তু তা হয়নি।
একদিন শেফালীর সাথে সাক্ষাতের জন্য সল্টলেক এলাম। অসংখ্য আবাসন। টাওয়ার। বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে খুঁজতে এক বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে শেফালি ম্যাডামের নাড়ি নক্ষত্র সব পেলাম। বললাম আমি ওর ছোটবেলার ক্লাস মেট।
আমি তো আবার থ। শেফালীর স্বামী তাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সাথে পালিয়েছে। সে তার একমাত্র ছেলেকে বহু কষ্টে টিউশানি করে মানুষ করেছে। হায়ার এডুকেশন দিয়েছে। উচ্চশিক্ষিত ছেলে বিয়ে করে আমেরিকায় আজ বছর দশেক হলো সেখানেই থাকে। ইন্ডিয়ায় আসা তো দুরের কথা খোঁজ খবরও নেয় না। ফোন পর্যন্ত করে না।
-ছেলে মাকে ফোন করেনা? অবাক কান্ড।
-হ্যাঁ। আসলে বউটি বড়লোকের বখাটে মেয়ে। বহু ছেলের সাথে লটঘট করে অবশেষে শেফালী দিদির ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে, চরিত্রহীনা। শেফালি প্রতিবাদ করায় তাকেই বয়কট করেছে।
-এ কি রকম যুগ। ভাবতেই শিউড়ে উঠছি।
নানান কাজে আমি শেফালিদিদিকে সহায়তা করি বলে আমাকে সব কথা খুলেই বলে থাকেন। আপনি আমার নাম নেবেন না স্যার। শেফালী দিদির কেউ নেই। আপনি বাল্যবন্ধু বলেই আপনাকে সব কথা বললাম।
-আর মেয়ে?
-আর কোনো মেয়ে নেই।
-ব্যাঙ্গালোরে যে থাকে?
-সে সব আপনাকে মিথ্যা বলেছে। শুনেছি সেখানে ওনার আপনার মতো কোনো বাল্যবন্ধু থাকে।
চলুন আমি আপনাকে ফ্ল্যাট দেখিয়ে দিয়ে আসি।
লিফটে করে ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল সিকিউরিটি গার্ডটি। আমি বেল বাজাতে দরজা খুলে দিয়ে স্বাগত জানাল শেফালি।
বিশাল ফ্ল্যাট। একা শেফালি। টিভি চলছে। আমাকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল। বললাম তুই তো রান্না করছিস। তবে টিভি চলছে। কে দেখছে?
-টিভি চললে মনে হয় কেউ তো কথা বলছে।
-আর আরতি?
-সেও নিরুদ্দেশ। কোন এক ক্রোড়পতি তাকে নিয়ে চলে গেছে।
-কি আশ্চর্য? আমি হতবাক। তুই তো আমাকেও মিথ্যা বলেছিস।
-এই মিথ্যা বলাটা আমি আরতির কাছ থেকে শিখেছি।
নারীর এই অত্যাশ্চর্য দর্শন পেয়েছি আরতির কাছ থেকে। পরিবার থেকে হাজার দুঃখ পেলেও তারা আমার আপনজন। আমার অতীত স্মৃতি। আপনজনের বিরুদ্ধে বলে কি লাভ? আকাশে থুতু ফেললে তো নিজের গায়ে পড়ে। সবই ভাগ্য। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।
-আমি সারাদিন থাকলাম। সঙ্গ দিলাম। খুব সুন্দর সুন্দর সুস্বাদু পদের রান্না করে খাওয়ালো শেফালী। আমি আপ্যায়নে ধন্য হলাম।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।
আবার আসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে
বিদায় নিলাম। আরতি ও শেফালীর
এই আশ্চর্য দর্শন, ভারতীয় দর্শন উপলব্ধি করে, গ্রহণ করে ফিরে এলাম।
মনের মধ্যে গেঁথে রইল ভারতীয় নারীর দর্শন।
অপূর্ব
ধন্যবাদ
osamannyo
আপনার মন্তব্য ও মুগ্ধতায় খুশি হলাম। ধন্যবাদ অফুরন্ত প্রিয় শিল্পী